গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজবের যেন ডালপালা গজিয়ে ওঠে। প্রতিমুহূর্ত গুজবে সয়লাব হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থান-পরবতীতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। যা দেশের মানুষের প্রত্যাশিত ছিল। তারপর থেকে বিরামহীন চলছে মিথ্যা-গুজবের বহর। বিশেষ করে বিগত সরকারের দোসরদের এ সময় বেশি তৎপর দেখা যায়। কেউ কেউ ঢাহা মিথ্যা চালাচালি করে আবার এমনভাবে প্রচার করে যেন গুজবকেও হার মানিয়ে দেয়। এ কথা সত্য, গুজব ও অপপ্রচারের বিষয়টি একেবারে নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক এর প্রভাব ও বিস্তার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন। এমনকি যেকোনো মুহূর্তে ক্ষমতা নিচ্ছে সেনাবাহিনী, এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ২২ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত এমন খবর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। বিভিন্ন ফেসবুক পেজ থেকে একের পর এক পোস্ট দিয়ে ছড়ানো হয় এসব গুজব। আর কোনো বিচার ছাড়াই এগুলোকে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করেন অপপ্রচারকারীরা।
এ গুজবের পেছনে রয়েছে পুরোনো কিছু ভিডিও ও ভুয়া ছবি, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে এডিটেড করে প্রচার করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার নামক ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ ধরনের ভিডিও বা ছবি বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই। এর মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অপ্রত্যাশিত বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। একইভাবে সেনাবাহিনী বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার নামে ভুয়া প্রেস রিলিজ এবং গুজবও প্রচার করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত রিউমর স্ক্যানার ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ১ হাজার ১৩টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪১টিই এআই দিয়ে তৈরি করা ভুয়া কনটেন্ট। এ ছাড়া ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে, এমন কনটেন্ট শনাক্ত হয়েছে ১০টি। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার এ গুজব বিস্তারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এআই প্রযুক্তি তৈরি ভুয়া কনটেন্ট সাধারণত বাস্তবের মতো মনে হয়, তাতে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বোঝা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। এর ফলে দেশের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ও সামাজিক জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সামাজিক মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এসব গুজবের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সাধারণ মানুষকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। ভুয়া খবর সন্দেহের চোখে দেখা এবং নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফ্যাক্ট চেকিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত ভুল তথ্য চিহ্নিত করে দ্রুতই তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া।
গুজব ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার বিকল্প নেই। সমাজের প্রতিটি স্তরে এ ব্যাপারে জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। মনে রাখতে হবে মনোবিজ্ঞানীর ভাষায় গুজব ছড়ানো এক ধরনে অসুস্থতা। এ ক্ষেত্রে তথ্যের সত্যতা যাচাই না করে শেয়ার না করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা অতীব জরুরি। তবেই আমরা এক সুন্দর, সত্য ও বিভ্রান্তিমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারব। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, সত্যের পথে থেকে সমাজকে আরও দায়িত্বশীল ও সচেতন করে তোলা।