উৎসবকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাময়িকী ও পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ আমাদের সাহিত্যে নব উদ্যম ও চাঞ্চল্য নিয়ে আসে। বলাই বাহুল্য, বর্তমানে নিউজ পোর্টাল, লিটারারি ওয়েব পোর্টালের বিশেষ আয়োজনও এর সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে উৎসবকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চায় প্রধান ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীর ঈদসংখ্যা, যেটি মূলত ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে প্রকাশিত হয়। মোটামুটিভাবে এটি এখন আমাদের উৎসবকেন্দ্রিক ঐতিহ্যেরই অংশ হয়ে গেছে।
ইতিহাস থেকে দেখে যায়, ১৯০৩ সালে বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে প্রথম ঈদসংখ্যাটি প্রকাশ করে ‘নবনূর’ পত্রিকা। ১৯৩৬ সালে সিলেটে থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক আল্ ইসলাহ’ পত্রিকা ঈদসংখ্যা প্রকাশ করে। ১৯৩৮ সালে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ এবং ১৯৪০ সালে ‘মদীনা’ প্রকাশিত হয়।
১৯৪০ সালে আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদনায় ‘কৃষক’ পত্রিকা থেকে ‘কৃষক-ঈদুলফেতর ১৩৪৭’ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৪১ সালে ‘পল্লী বান্ধব’ পত্রিকা ‘কোরবাণী সংখ্যা’ প্রকাশ করে। ১৯৪৬ সালে মিল্লাতের ঈদসংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮ সালে ‘বেগম’ পত্রিকার প্রথম ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হয়। মোটামুটিভাবে এই হলো শুরু।
…তখন সাহিত্যচর্চা থেকে সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ঈদসংখ্যায় বিষয়-বৈচিত্র্য আনার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’। সঙ্গে ছিল ‘পূর্বাণী’। পরে অবশ্য যুক্ত হয় ‘চিত্রালী’, ‘রোববার’, ‘সচিত্র সন্ধানী’র ঈদসংখ্যাগুলো।
এরপর ঈদসংখ্যা প্রকাশ আমাদের সাহিত্যচর্চা ও উৎসব উদযাপনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। শুরুর দিকে ঈদসংখ্যায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও পরবর্তী সময়ে ঈদসংখ্যার বিষয় হয়ে ওঠে চলচ্চিত্র, সংগীত, চিত্রকলা, খেলাধুলা থেকে শুরু করে ফ্যাশন, বিনোদন ও লাইফস্টাইল।
তখন সাহিত্যচর্চা থেকে সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ঈদসংখ্যায় বিষয়-বৈচিত্র্য আনার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’। সঙ্গে ছিল ‘পূর্বাণী’। পরে অবশ্য যুক্ত হয় ‘চিত্রালী’, ‘রোববার’, ‘সচিত্র সন্ধানী’র ঈদসংখ্যাগুলো। পর্যায়ক্রমে ঈদসংখ্যা নিয়ে আসে দেশের প্রতিটা জাতীয় দৈনিক।
নব্বইয়ের দশকে শুধু লেখক, পাঠক না; সংস্কৃতিমনস্ক মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় ঈদের নিত্যশপিংয়ে অংশ হয়ে ওঠে ঈদসংখ্যা। যিনি হয়তো গল্প কবিতা পড়েন না, তিনি প্রকাশিত রেসিপিগুলো দেখেন। কেউ হয়তো ফ্যাশন ক্যাটালগ দেশে পোশাক কেনার কথা ভাবেন। কেউ পড়েন বিনোদনের অংশ, কিংবা রূপচর্চার বিষয়াদি।
আমি নিজে ‘পাক্ষিক অনন্যা’র ঈদসংখ্যা সম্পাদনা করেছি প্রায় এক দশক। দেখেছি, ভ্রমণগদ্য, সাক্ষাৎকার, সিনেমার আলোচনার পাশাপাশি রাশিফল বিষয়ক লেখাতেও আগ্রহী পাঠকের কমতি ছিল না। ‘অনন্যা’ কোনো কোনো ঈদে তিনটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। একটি চিরায়ত ঈদসংখ্যা, দ্বিতীয়টি ঈদ ফ্যাশন সংখ্যা, তৃতীয় হচ্ছে ঈদ রেসিপি সংখ্যা।
বিভিন্ন ঈদসংখ্যায় লেখা জমা দেওয়ার জন্য বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় লেখকরা সবচেয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। প্রকাশনার মুহূর্তে পত্রিকাগুলোর অফিসে ঈদের আগাম আমেজ চলে আসে। রমজানের মাঝামাঝি থেকে ঈদসংখ্যা হয়ে ওঠে পাঠকের। লেখক মহলেও কারও উপন্যাস, প্রয়াত কোনো লেখকের অপ্রকাশিত রচনা, গল্প-সাক্ষাৎকার থেকে শুরু করে কবিতা, প্রবন্ধ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। আলোচনা কখনো কখনো পরিণত হয় মৃদু বাহাসে। এসব আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি।
বিশেষত ২০১০ সাল থেকে করোনার আগ পর্যন্ত ঈদসংখ্যার আমেজ আমার দেখা ও কর্মসূত্রে কিছুটা যাপন করাও। কিন্তু কোভিড এসে অনেক কিছু বদলে যায়। করোনার বছরটাতে অধিকাংশ পত্রিকা ঈদসংখ্যা প্রকাশ করেনি। এ সময় কয়েকটি দৈনিক ও পত্রপত্রিকা অনলাইনে ঈদসংখ্যার আয়োজন করে। এরপর কোভিড চলে গেলেও কেউ কেউ আর প্রিন্টে ফেরেনি। যেমন, অনন্যার কথা বলতে পারি। কোভিডের পর অনন্যার প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ হয়ে যায়।
ঈদসংখ্যার যখন শ্রেষ্ঠ সময় তখন আমরা এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তর্ক করেছি। পক্ষে-বিপক্ষে নানামত ছিল। লেখকরা ঈদসংখ্যায় লেখার জন্য তাড়াহুড়ো করে গল্প-উপন্যাস লেখেন, যেগুলোর অধিকাংশ মানোত্তীর্ণ হয় না বলে অনেকের অভিযোগ। অভিযোগ সর্বাংশে মিথ্যা না। তবে এও স্বীকার করতে হয়, ঈদসংখ্যার মধ্য দিয়ে আমরা বেশকিছু ভালো উপন্যাস পেয়েছি।
উৎসবকে সর্বজনীন করে তোলার পেছনে ঈদসংখ্যা এবং কলকাতা থেকে আসা পূজাসংখ্যাগুলোর বিশেষ ভূমিকা ছিল। সর্বোপরি মফস্বলের সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে সংস্কৃতিচর্চা ও বিনোদনেও ঈদসংখ্যা বা পূজাসংখ্যার কম ভূমিকা ছিল না।
আমি ঈদসংখ্যা সম্পাদনা করলেও সে সময় ঈদসংখ্যা প্রকাশের বিষয়ে ইতিবাচক ছিলাম না। ঈদসংখ্যা সাহিত্যের ভালোর চেয়ে মন্দ করছে বলেও মনে করেছি কিছুটা সময়। সেই কারণে নিজে ঈদসংখ্যায় লেখার ব্যাপারে মনোযোগী হতে পারিনি। এমনকি পাঠক হিসেবেও ঈদসংখ্যা সংগ্রাহকের দলে ছিলাম না কখনো।
পাঁচ বছরে আমার ভিন্ন উপলব্ধি হয়েছে। এখন মনে হয়, ঈদসংখ্যা লেখক তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ না হলেও পাঠকসৃষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় শিল্প-সাহিত্য চর্চার যে সংস্কৃতি, তার সঙ্গে ঈদসংখ্যার খুব মধুর একটা সম্পর্ক রয়েছে। আগে যেখানে শিক্ষিত পরিবারগুলোয় বিভিন্ন ঈদসংখ্যা, পূজাসংখ্যা দেখা যেত। নতুনের পাশাপাশি বিগত বছরগুলোর সংখ্যাও থাকত। পাশাপাশি মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো দেখা যেত। এখন আর সেগুলো দেখা যায় না। মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো তো বন্ধই হয়ে গেল। অনেক সময় একটি ঈদসংখ্যার জনপ্রিয়তা ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে একটি পত্রিকা টিকে থাকতে পারত। কিন্তু সেই বাস্তবতা সম্ভবত আর নেই।
হ্যাঁ, এখনো ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হয়—আরও বর্ধিত কলেবরে, আরও ভালো কাগজে। ঢাকা ক্লাবে ঈদসংখ্যাকে কেন্দ্র করে পার্টিও বসে। কিন্তু এখন আর মফস্বল শহরগুলোয় ঈদসংখ্যাগুলো পৌঁছায় না। এখন ঈদসংখ্যার সংস্কৃতি টিকে আছে রাজধানীকে কেন্দ্র করে। যে কারণে আকারে ঢাউস হলেও মুদ্রণ সংখ্যা কমে গেছে। কমতে কমতে কিছু কিছু তো বন্ধও হয়ে গেছে বা যাচ্ছে এবং এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সংস্কৃতিচর্চায়।
ঘরে ঘরে পাঠ বিমুখ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। ঈদসংখ্যাগুলোর আমেজ না থাকার কারণে সিনেমা, সংগীত, চিত্রকলা নিয়ে লেখার লোকজনও কমে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। সাহিত্যে বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখালেখির যে চর্চা, তাতে ঈদসংখ্যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। গল্প-কবিতা সৃজনশীল লেখকরা এমনিতেও কম বেশি লেখেন। কিন্তু মননশীল রচনা ও বিবিধ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহিত্য সম্পাদকদের ভূমিকার কথা অবশ্যই স্মরণ করতে হবে।
বলতে অসুবিধা নেই, ঈদসংখ্যায় সৃজনশীল লেখা না পড়লেও মননশীল রচনা পড়ি। সবচেয়ে বেশি এড়িয়ে যাই উপন্যাসকে। ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত অধিকাংশ উপন্যাসই অসমাপ্ত। কোনো কোনো লেখক একটি উপন্যাসকে তিনটি ভাগ করে তিন শিরোনামে তিনটি ঈদসংখ্যায় প্রকাশ করেন। ন্যায় অন্যায়ের বিষয় কিছু না।
উৎসব সংখ্যাকে আমি অতো রিলিজিয়াসলি দেখি না। একটা ঈদসংখ্যায় সব লেখা পড়তে হবে এমনও না। কিন্তু প্রত্যেকে তার পড়ার মতো কিছু না কিছু খুঁজে পান। একটা ঈদসংখ্যা হাতে নিয়ে এক সপ্তাহ খুব ভালো সময় কাটে, কারও ক্ষেত্রে সেটা এক মাসও হতে পারে। এই সময়টাই এখন হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো সময় আছে, অনুভবের শক্তিটা আর নেই।
আলোচনা শেষ করবো ভিন্ন একটা উপলব্ধি দিয়ে। আমরা দেখেছে, প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের ছিল। ছিল বলছি কারণ এখন ধর্মীয় উৎসবের উদার ভাবটা কমে যাচ্ছে। আমরা যে বলি, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’, সেটাও এখন কাগজে-কথনে পরিণত হচ্ছে। এখন হয়ে যাচ্ছে—ধর্ম যার যার, উৎসবও তার তার। অন্তত এমন একটা পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছি আমরা। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু ঈদসংখ্যার আবেদন কমে যাওয়া এবং মফস্বলগুলো থেকে ঈদসংখ্যার চল উঠে যাওয়াকেও আমি একটি কারণ হিসেবে দেখতে চাই।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, উৎসবকে সর্বজনীন করে তোলার পেছনে ঈদসংখ্যা এবং কলকাতা থেকে আসা পূজাসংখ্যাগুলোর বিশেষ ভূমিকা ছিল। সর্বোপরি মফস্বলের সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে সংস্কৃতিচর্চা ও বিনোদনেও ঈদসংখ্যা বা পূজাসংখ্যার কম ভূমিকা ছিল না। উৎসবকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা ও প্রকাশনার গুরুত্বকে তাই আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। সাহিত্যের প্রয়োজনে না হলেও সমাজের প্রয়োজনে ঈদসংখ্যার দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে।
মোজাফ্ফর হোসেন ।। কথাসাহিত্যিক