5:46 pm, Sunday, 22 June 2025

বাংলাদেশ-জাপান অংশীদারত্বে নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বরাবরই ছিল সৌহার্দ ও সহযোগিতাপূর্ণ। তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক টোকিও সফর এই সম্পর্ককে একটি নতুন ও গভীরতর স্তরে উন্নীত করেছে। অর্থনীতি, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ ও কৌশলগত সহযোগিতার বিস্তৃত মাত্রা ছুঁয়ে যাওয়া এই সফর শুধু একটি কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি দুই দেশের পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধা ও একসঙ্গে ভবিষ্যৎ নির্মাণেও নিদর্শন।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, জাপানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ১ দশমিক ০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা। শুক্রবার সময়ের আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অর্থের মধ্যে ৪১৮ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে উন্নয়ন নীতি ঋণ হিসেবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সহায়তা করবে। ৬৪১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রুটে ডুয়েল গেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণে, যা দেশের রেল পরিবহন ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনবে। এ ছাড়া ৪.২ মিলিয়ন ডলার স্কলারশিপ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে অনুদান হিসেবে বরাদ্দ করা হয়েছে।
এই সফরে জাপানে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের প্রতিশ্রুতি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক লাখ শ্রমিক নিয়োগের কথা জানিয়েছে জাপানি কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা। টোকিওতে ‘বাংলাদেশ সেমিনার অন হিউম্যান রিসোর্সেস’-এ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাপানে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে। তিনি এটিকে এক ‘রোমাঞ্চকর ও প্রেরণার দিন’ বলে অভিহিত করেন, যা শুধু চাকরি নয়, বরং জাপানকে জানারও দ্বার খুলে দেবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য।
শুধু সরকারি পর্যায়ের চুক্তি নয়, এই সফরে ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনার’-এর ফাঁকে ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও শিল্পোন্নয়নে জাপানের আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস মিটার ফ্যাক্টরি স্থাপন, ব্যাটারিচালিত সাইকেল ও মোটরসাইকেল তৈরির কারখানা, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ উৎপাদন কেন্দ্র, কিপার প্রযুক্তির মাধ্যমে তথ্য নিরাপত্তা জোরদারে পাইলট প্রকল্প এবং বিডার সঙ্গে জাইকার একটি বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম গঠন। এই উদ্যোগগুলো কেবল কর্মসংস্থান সৃষ্টি নয়, বরং প্রযুক্তি স্থানান্তর ও শিল্প খাতে দক্ষতা বৃদ্ধির পথও সুগম করবে।
রাজনৈতিক ও কৌশলগত অঙ্গনে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুই দেশের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতিসংঘ সনদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। জাপানের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি স্থানান্তরের সম্ভাবনা এই অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
রোহিঙ্গা সংকটেও জাপানের সহানুভূতিশীল অবস্থান বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে শক্তি জোগাবে। রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে জাপান তাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবী ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। এই অবস্থান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সমর্থনকে দৃঢ় করবে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরে প্রকাশিত বার্তাটি স্পষ্ট, জাপান বাংলাদেশের প্রতি শুধু উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদার হিসেবেই এগিয়ে এসেছে। চুক্তি, সমঝোতা ও প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সরকার যদি দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যায়, তা হলে এই সফর হতে পারে দুই দেশের সম্পর্কের এক মাইলফলক। যেখান থেকে শুরু হবে উন্নয়ন, আস্থা ও পারস্পরিক সহযোগিতার এক নতুন যুগ।
Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশ-জাপান অংশীদারত্বে নতুন দিগন্ত

Update Time : 10:30:36 am, Sunday, 8 June 2025
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বরাবরই ছিল সৌহার্দ ও সহযোগিতাপূর্ণ। তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক টোকিও সফর এই সম্পর্ককে একটি নতুন ও গভীরতর স্তরে উন্নীত করেছে। অর্থনীতি, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ ও কৌশলগত সহযোগিতার বিস্তৃত মাত্রা ছুঁয়ে যাওয়া এই সফর শুধু একটি কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি দুই দেশের পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধা ও একসঙ্গে ভবিষ্যৎ নির্মাণেও নিদর্শন।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, জাপানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ১ দশমিক ০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা। শুক্রবার সময়ের আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অর্থের মধ্যে ৪১৮ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে উন্নয়ন নীতি ঋণ হিসেবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সহায়তা করবে। ৬৪১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রুটে ডুয়েল গেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণে, যা দেশের রেল পরিবহন ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনবে। এ ছাড়া ৪.২ মিলিয়ন ডলার স্কলারশিপ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে অনুদান হিসেবে বরাদ্দ করা হয়েছে।
এই সফরে জাপানে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের প্রতিশ্রুতি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক লাখ শ্রমিক নিয়োগের কথা জানিয়েছে জাপানি কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা। টোকিওতে ‘বাংলাদেশ সেমিনার অন হিউম্যান রিসোর্সেস’-এ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাপানে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে। তিনি এটিকে এক ‘রোমাঞ্চকর ও প্রেরণার দিন’ বলে অভিহিত করেন, যা শুধু চাকরি নয়, বরং জাপানকে জানারও দ্বার খুলে দেবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য।
শুধু সরকারি পর্যায়ের চুক্তি নয়, এই সফরে ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনার’-এর ফাঁকে ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও শিল্পোন্নয়নে জাপানের আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস মিটার ফ্যাক্টরি স্থাপন, ব্যাটারিচালিত সাইকেল ও মোটরসাইকেল তৈরির কারখানা, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ উৎপাদন কেন্দ্র, কিপার প্রযুক্তির মাধ্যমে তথ্য নিরাপত্তা জোরদারে পাইলট প্রকল্প এবং বিডার সঙ্গে জাইকার একটি বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম গঠন। এই উদ্যোগগুলো কেবল কর্মসংস্থান সৃষ্টি নয়, বরং প্রযুক্তি স্থানান্তর ও শিল্প খাতে দক্ষতা বৃদ্ধির পথও সুগম করবে।
রাজনৈতিক ও কৌশলগত অঙ্গনে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুই দেশের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতিসংঘ সনদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। জাপানের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি স্থানান্তরের সম্ভাবনা এই অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
রোহিঙ্গা সংকটেও জাপানের সহানুভূতিশীল অবস্থান বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে শক্তি জোগাবে। রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে জাপান তাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবী ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। এই অবস্থান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সমর্থনকে দৃঢ় করবে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরে প্রকাশিত বার্তাটি স্পষ্ট, জাপান বাংলাদেশের প্রতি শুধু উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদার হিসেবেই এগিয়ে এসেছে। চুক্তি, সমঝোতা ও প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সরকার যদি দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যায়, তা হলে এই সফর হতে পারে দুই দেশের সম্পর্কের এক মাইলফলক। যেখান থেকে শুরু হবে উন্নয়ন, আস্থা ও পারস্পরিক সহযোগিতার এক নতুন যুগ।