5:47 pm, Sunday, 22 June 2025

বাংলাদেশে যেভাবে গরু কোরবানি মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হলো

ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদে প্রতি বছর বাংলাদেশে লাখ লাখ গরু কোরবানি হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছাগল, ভেড়া বা দুম্বার মতো পশু কোরবানি দেওয়া হলেও বাংলাদেশে গরু কোরবানি যেন একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে হাজারো কোরবানির পশুর হাট বসে। সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা এসব হাটে লাখ লাখ গরু বিক্রি হয়। এসব হাটে গরু ছাড়াও ছাগল, ভেড়া পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ মানুষের কাছে হাটের পরিচিতি ‘গরুর হাট’ নামেই।

বর্তমানে বাংলাদেশে গরু কোরবানি, হাট বসিয়ে বেচাকেনা ঈদুল আজহার সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়ালেও এক সময় বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানি দেওয়া এতটা সহজসাধ্য ছিল না।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার ‘বাংলাদেশের উৎসব’ বইয়ে লিখেছেন, আজকে আমরা যে ধুমধামের সঙ্গে ঈদ-উল আজহা পালন করি, তা চল্লিশ–পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য মাত্র।

তার বই অনুযায়ী, তখন হিন্দু জমিদার অধ্যুষিত এই ভূখণ্ডে গরু কোরবানি দেওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। এ জন্য অনেকে গরুর বদলে বকরি কোরবানি দিত, সেই থেকে ঈদুল আজহার আরেক নাম দাঁড়ায় বকরি ঈদ।

ইসলামি ইতিহাসবিদরা বলছেন, এক সময় আরব বিশ্বে উট, মহিষ ও দুম্বা কোরবানি দেওয়ার প্রচলন ছিল। সেখান থেকে পরে বাংলা অঞ্চলেও মহিষ ও ছাগলের সাথে গরুর কোরবানির পশু হিসেবে যুক্ত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বলেন, সেই সময় এই উপমহাদেশ ও আশপাশে গরুকে সবচেয়ে বেশি হাতের কাছে পাওয়া যেতো। তখন উট ও মহিষের সাথে গরুটাও ওই সময়ে যুক্ত হয়ে গেল।

একসময় এই উপমহাদেশে গরু কোরবানিতে বিধিনিষেধ থাকলেও পরে সেটি কবে কীভাবে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল, বাংলা অঞ্চলের সংস্কৃতিতে সেসব নিয়ে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যায় ইতিহাসের গল্প-উপন্যাসে।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে, বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানি দেওয়ার রীতি শুরু হতে থাকে মূলত ১৯৪৬ সালের দিকে।

বাংলা অঞ্চলে কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায় ইতিহাসবিদদের লেখায়।

অনেক সাহিত্যেই বলা আছে, তখন ছাগল বা বকরি কোরবানির প্রথা থেকে মূলত ঈদুল আজহা ‘বকরি ঈদ’ নামেই পরিচিত ছিল। লেখক আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘আত্মকথা’য় লিখেছেন—দাদাজীর আমলে মোহররম পর্বে আমাদের বাড়িতে এত ধুম ধড়াক্কা হইলেও দুই ঈদে কিন্তু অমন বিশেষ কিছু হইত না। বকরিদে প্রথম প্রথম দুই-তিনটা ও পরে মাত্র একটা গরু কোরবানি হইত।

তখনকার সময়ে ঈদ পালনের রীতি বা প্রচলন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে নানা ধরনের তথ্য এসেছে। এর বেশিরভাগে সুলতানি, মুঘল কিংবা ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলে কোরবানির ঈদের কিছু চিত্র বোঝা যায়।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী ‘কাল নিরবধি’তে লিখেছেন, বকরি ঈদে আমরা প্রতিবছর কোরবানি দিতাম না, মাঝে মাঝে তা বাদ পড়ত ভক্তির অভাবে ততটা নয়, যতটা সামর্থ্যের অভাবে। বড়রা চেষ্টা করতেন, পশু জবাই থেকে আমাদের আড়াল করতে। আমরা ছোটরা ততোধিক উৎসাহে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে জবাই দেখে ফেলতাম। দেখার পরে কিন্তু অনেকক্ষণ বিষাদে মন ছেয়ে যেত। তবে শেষ পর্যন্ত এই বিষণ্নতা পেছনে ফেলে দেখা দিত কোরবানির গোশত খাওয়ার উৎসাহ।

সেই সময়ে কোরবানির ইতিহাস নিয়ে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে সে সময়ে বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানির প্রচলন না থাকার পেছনে নানা ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় ইতিহাসের আলোচনায়।

এক সময় এই অঞ্চলে কোরবানির ঈদে গরু জবাইয়ে কড়াকড়ি থাকলেও আস্তে আস্তে সে চিত্র পাল্টাতে থাকে বলে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন গল্প প্রবন্ধে উঠে এসেছে।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরই আস্তে আস্তে গরু কোরবানির পরিমাণ বাড়তে থাকে। তখন কোরবানির আমেজ বেশি ছিল পুরানো ঢাকায়।

তখন ঢাকায় কোরবানির ঈদের আগে কিছু কিছু জায়গায় গরু ছাগলের হাট বসতো। তখনকার বিখ্যাত একটি হাট ছিল রহমতগঞ্জের গণি মিয়ার হাট। তখন ঢাকার লোকসংখ্যা কম ছিল। ঈদুল আজহার আগে গণি মিয়ার হাট ছাড়াও গাবতলী, সোয়ারীঘাট ও জিঞ্জিরায় গরুর হাট থেকে অনেকে গরু কিনতেন।

ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৫০ এর দশকে ঢাকায় স্বাভাবিক আকারের একটি গরুর দাম ছিল ৩০ থেকে ৫০ টাকা।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, কোরবানির ঈদের দিন থেকে শুরু করে তিনদিন পর্যন্ত পশু জবাই করা যায়। তখন পুরনো ঢাকার অনেক পরিবার ঈদের পরের দিন কিংবা তার পরের দিনও অনেকে গরু কোরবানি করতেন।

সূত্র- বিবিসি বাংলা

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশে যেভাবে গরু কোরবানি মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হলো

Update Time : 05:21:56 am, Sunday, 8 June 2025

ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদে প্রতি বছর বাংলাদেশে লাখ লাখ গরু কোরবানি হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছাগল, ভেড়া বা দুম্বার মতো পশু কোরবানি দেওয়া হলেও বাংলাদেশে গরু কোরবানি যেন একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে হাজারো কোরবানির পশুর হাট বসে। সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা এসব হাটে লাখ লাখ গরু বিক্রি হয়। এসব হাটে গরু ছাড়াও ছাগল, ভেড়া পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ মানুষের কাছে হাটের পরিচিতি ‘গরুর হাট’ নামেই।

বর্তমানে বাংলাদেশে গরু কোরবানি, হাট বসিয়ে বেচাকেনা ঈদুল আজহার সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়ালেও এক সময় বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানি দেওয়া এতটা সহজসাধ্য ছিল না।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার ‘বাংলাদেশের উৎসব’ বইয়ে লিখেছেন, আজকে আমরা যে ধুমধামের সঙ্গে ঈদ-উল আজহা পালন করি, তা চল্লিশ–পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য মাত্র।

তার বই অনুযায়ী, তখন হিন্দু জমিদার অধ্যুষিত এই ভূখণ্ডে গরু কোরবানি দেওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। এ জন্য অনেকে গরুর বদলে বকরি কোরবানি দিত, সেই থেকে ঈদুল আজহার আরেক নাম দাঁড়ায় বকরি ঈদ।

ইসলামি ইতিহাসবিদরা বলছেন, এক সময় আরব বিশ্বে উট, মহিষ ও দুম্বা কোরবানি দেওয়ার প্রচলন ছিল। সেখান থেকে পরে বাংলা অঞ্চলেও মহিষ ও ছাগলের সাথে গরুর কোরবানির পশু হিসেবে যুক্ত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বলেন, সেই সময় এই উপমহাদেশ ও আশপাশে গরুকে সবচেয়ে বেশি হাতের কাছে পাওয়া যেতো। তখন উট ও মহিষের সাথে গরুটাও ওই সময়ে যুক্ত হয়ে গেল।

একসময় এই উপমহাদেশে গরু কোরবানিতে বিধিনিষেধ থাকলেও পরে সেটি কবে কীভাবে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল, বাংলা অঞ্চলের সংস্কৃতিতে সেসব নিয়ে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যায় ইতিহাসের গল্প-উপন্যাসে।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে, বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানি দেওয়ার রীতি শুরু হতে থাকে মূলত ১৯৪৬ সালের দিকে।

বাংলা অঞ্চলে কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায় ইতিহাসবিদদের লেখায়।

অনেক সাহিত্যেই বলা আছে, তখন ছাগল বা বকরি কোরবানির প্রথা থেকে মূলত ঈদুল আজহা ‘বকরি ঈদ’ নামেই পরিচিত ছিল। লেখক আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘আত্মকথা’য় লিখেছেন—দাদাজীর আমলে মোহররম পর্বে আমাদের বাড়িতে এত ধুম ধড়াক্কা হইলেও দুই ঈদে কিন্তু অমন বিশেষ কিছু হইত না। বকরিদে প্রথম প্রথম দুই-তিনটা ও পরে মাত্র একটা গরু কোরবানি হইত।

তখনকার সময়ে ঈদ পালনের রীতি বা প্রচলন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে নানা ধরনের তথ্য এসেছে। এর বেশিরভাগে সুলতানি, মুঘল কিংবা ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলে কোরবানির ঈদের কিছু চিত্র বোঝা যায়।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী ‘কাল নিরবধি’তে লিখেছেন, বকরি ঈদে আমরা প্রতিবছর কোরবানি দিতাম না, মাঝে মাঝে তা বাদ পড়ত ভক্তির অভাবে ততটা নয়, যতটা সামর্থ্যের অভাবে। বড়রা চেষ্টা করতেন, পশু জবাই থেকে আমাদের আড়াল করতে। আমরা ছোটরা ততোধিক উৎসাহে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে জবাই দেখে ফেলতাম। দেখার পরে কিন্তু অনেকক্ষণ বিষাদে মন ছেয়ে যেত। তবে শেষ পর্যন্ত এই বিষণ্নতা পেছনে ফেলে দেখা দিত কোরবানির গোশত খাওয়ার উৎসাহ।

সেই সময়ে কোরবানির ইতিহাস নিয়ে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে সে সময়ে বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানির প্রচলন না থাকার পেছনে নানা ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় ইতিহাসের আলোচনায়।

এক সময় এই অঞ্চলে কোরবানির ঈদে গরু জবাইয়ে কড়াকড়ি থাকলেও আস্তে আস্তে সে চিত্র পাল্টাতে থাকে বলে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন গল্প প্রবন্ধে উঠে এসেছে।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরই আস্তে আস্তে গরু কোরবানির পরিমাণ বাড়তে থাকে। তখন কোরবানির আমেজ বেশি ছিল পুরানো ঢাকায়।

তখন ঢাকায় কোরবানির ঈদের আগে কিছু কিছু জায়গায় গরু ছাগলের হাট বসতো। তখনকার বিখ্যাত একটি হাট ছিল রহমতগঞ্জের গণি মিয়ার হাট। তখন ঢাকার লোকসংখ্যা কম ছিল। ঈদুল আজহার আগে গণি মিয়ার হাট ছাড়াও গাবতলী, সোয়ারীঘাট ও জিঞ্জিরায় গরুর হাট থেকে অনেকে গরু কিনতেন।

ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৫০ এর দশকে ঢাকায় স্বাভাবিক আকারের একটি গরুর দাম ছিল ৩০ থেকে ৫০ টাকা।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, কোরবানির ঈদের দিন থেকে শুরু করে তিনদিন পর্যন্ত পশু জবাই করা যায়। তখন পুরনো ঢাকার অনেক পরিবার ঈদের পরের দিন কিংবা তার পরের দিনও অনেকে গরু কোরবানি করতেন।

সূত্র- বিবিসি বাংলা